ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি নাম যা দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। একজন বাংলাদেশি সমাজসেবক, অর্থনীতিবিদ এবং নাগরিক সমাজের নেতা হিসেবে ড. ইউনূস তাঁর উদ্ভাবনী কাজের জন্য পরিচিত, যা ক্ষুদ্রঋণ এবং ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে। তাঁর এই অসাধারণ অবদান শুধু দারিদ্র্য বিমোচনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক ক্ষমতায়ন সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।
শৈশব ও শিক্ষা
১৯৪০ সালের ২৮ জুন, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের চট্টগ্রামের বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর পিতা ছিলেন একজন সফল গহনার ব্যবসায়ী এবং মাতা ছিলেন ধর্মপরায়ণা নারী, যিনি ছোটবেলা থেকেই ইউনূসকে সহানুভূতি ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মূল্যবোধ শেখান। তিনি পড়াশোনায় খুবই মেধাবী ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনার জন্য বৃত্তি পান। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে অর্থনীতিতে পিএইচডি অর্জন করেন।
ক্ষুদ্রঋণের ধারণার উদ্ভব
১৯৭০-এর দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক থাকাকালীন ড. ইউনূস ক্ষুদ্রঋণের ধারণাটি প্রবর্তন করেন। শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি অর্থনীতির তাত্ত্বিক জ্ঞান শিখিয়েছিলেন, কিন্তু দারিদ্র্যের কঠিন বাস্তবতার সাথে এই তত্ত্বগুলোর সঙ্গতি দেখতে পেতেন না। গ্রামের একটি পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এক মহিলার সাথে দেখা করেন, যিনি বাঁশের মোড়া তৈরি করতেন কিন্তু কাঁচামাল কেনার অর্থের অভাবে সামান্য আয় করতেন। এই ঘটনা তাঁকে উপলব্ধি করায় যে দরিদ্ররা প্রায়ই ঋণের অভাবে দরিদ্রতার দুষ্টচক্রে আটকে থাকে।
১৯৭৬ সালে, ড. ইউনূস নিজের পকেট থেকে মাত্র ৮৫৬ টাকা (তৎকালীন ২৭ ডলার) ৪২ জন গ্রামীণ মহিলাকে ধার দেন, যা তারা তাদের ছোট ব্যবসায় ব্যবহারের জন্য কাঁচামাল কিনতে ব্যবহার করে। এই ছোট্ট পরীক্ষার সফলতা তাঁকে ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে অনুপ্রাণিত করে, যা মূলত নারীদেরকে জামানতবিহীন ছোট ঋণ প্রদান করে। এই মডেলটি অত্যন্ত সফল প্রমাণিত হয় এবং ৯৮% এরও বেশি ঋণ পুনরুদ্ধার হার ছিল। গ্রামীণ ব্যাংকের এই উদ্যোগ দরিদ্রদেরকে উদ্যোক্তা হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়, যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের একটি চেইন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
বৈশ্বিক প্রভাব ও স্বীকৃতি
ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ মডেলটি দ্রুত বৈশ্বিক স্বীকৃতি অর্জন করে এবং এটি এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পুনরায় প্রয়োগ করা হয়। গ্রামীণ ব্যাংক ও তার নীতি বিশ্বব্যাপী একটি আন্দোলন তৈরি করেছে, যার ফলস্বরূপ অসংখ্য ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা গড়ে উঠেছে।
২০০৬ সালে, ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন, যা দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের অবদানের জন্য প্রদান করা হয়। নোবেল কমিটি ড. ইউনূসের উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদান করে।
সামাজিক ব্যবসা ও অন্যান্য উদ্যোগ
ক্ষুদ্রঋণের সাফল্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ড. ইউনূস সামাজিক উদ্যোক্তাবৃত্তিতে নতুন নতুন ধারণা প্রবর্তন করেছেন। তিনি সামাজিক ব্যবসার ধারণা উত্থাপন করেছেন—এমন ব্যবসা যা সমাজের সমস্যা সমাধানে নিবেদিত, লাভ অর্জনের জন্য নয়। এই ধারণাটি ব্যবসায়িক নীতিগুলি ব্যবহার করে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বের মতো সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করে।
তাঁর উল্লেখযোগ্য সামাজিক ব্যবসার উদ্যোগগুলির মধ্যে অন্যতম হলো গ্রামীণ দানোন, যা গ্রামীণ ব্যাংক এবং বহুজাতিক খাদ্য কোম্পানি দানোনের যৌথ উদ্যোগ। এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের পুষ্টিহীন শিশুদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে পুষ্টিকর দই সরবরাহ করা। এই উদ্যোগের মুনাফা ব্যবসার মধ্যে পুনরায় বিনিয়োগ করা হয়, যা এর স্থায়িত্ব ও সামাজিক প্রভাব নিশ্চিত করে।
সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জ
ড. ইউনূসের অসংখ্য স্বীকৃতি সত্ত্বেও, তিনি সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন, বিশেষত ক্ষুদ্রঋণের বাণিজ্যিকীকরণ সম্পর্কে। কিছু সমালোচক দাবি করেন যে ক্ষুদ্রঋণের মূল উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জনের জন্য ব্যাহত হয়েছে, যার ফলে উচ্চ সুদের হার এবং দরিদ্রদের শোষণ হচ্ছে। ইউনূস এই উদ্বেগগুলোকে স্বীকার করেছেন এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সামাজিক লক্ষ্য বজায় রাখার জন্য জোরালোভাবে কথা বলেছেন।
ড. ইউনূসের বাংলাদেশ সরকারের সাথে সম্পর্কও কখনও কখনও অশান্ত হয়েছে। ২০১১ সালে, তাঁকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, যা বয়স সংক্রান্ত উদ্বেগের উপর ভিত্তি করে ছিল। তবে অনেকেই মনে করেন যে এই পদক্ষেপটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল, কারণ ইউনূসের প্রভাব ও তার সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জড়িততা।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অবদান ক্ষুদ্রঋণের বাইরেও বিস্তৃত। তিনি দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক ব্যবসা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর কাজ নতুন প্রজন্মের সামাজিক উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করেছে, যারা বিশ্বাস করে যে ব্যবসা সমাজের কল্যাণে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।
ড. ইউনূস “তিনটি শূন্যের বিশ্ব”—শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব, এবং শূন্য নেট কার্বন নির্গমনের ধারণা প্রচার করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে সঠিক মানসিকতা এবং উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এই লক্ষ্যমাত্রা আমাদের জীবদ্দশায় অর্জনযোগ্য।
তাঁর এই অসামান্য প্রভাবের স্বীকৃতিস্বরূপ ড. ইউনূস অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল। তিনি এখনও লেখালেখি, বক্তৃতা এবং দারিদ্র্যমুক্ত, মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য কাজ করে চলেছেন।
উপসংহার
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উত্তরাধিকার উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি অবিচল প্রতিশ্রুতির সাক্ষ্য বহন করে। ক্ষুদ্রঋণে তাঁর পথিকৃত কাজ লক্ষ লক্ষ জীবনের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, এবং তাঁর সামাজিক ব্যবসায়িক ধারণা বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন ঘটানোর প্রেরণা জোগাচ্ছে। দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জটিল চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সময়, ড. ইউনূসের ধারণাগুলি একটি আশাব্যঞ্জক এবং ব্যবহারিক পথ প্রদান করে।